হাসিনা-কামালের নির্দেশেই গণহত্যা- ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি
- আপডেট সময় : ১০:৫১:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
- / 180
দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় নিজের দায়িত্ব ও অপরাধ স্বীকার করে সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) রাজসাক্ষী (Approver) হয়েছেন। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সরাসরি নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি হিসেবে থাকলেও, বিবেকের তাড়নায় তিনি অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান। এটি এ মামলার ৩৬তম সাক্ষীর জবানবন্দি।
গণহত্যার দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর জবানবন্দিতে অকপটে তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করেন।
কার নির্দেশে গণহত্যা: তিনি বলেন, “তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানো হয়।”
দায় স্বীকার: তিনি বলেন, “এতবড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে। তার দোষ আমি স্বীকার করছি।”
ক্ষমাপ্রার্থনা: সাবেক এই আইজিপি গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার ও আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। তিনি আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির পদ্ধতিও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন।
পুলিশে রাজনৈতিকীকরণ: ‘রাতের ভোটের’ নীলনকশা
সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে পুলিশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গোপালগঞ্জ-কেন্দ্রিক বলয় তৈরির চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেন।
‘রাতের ভোটের’ কারিগর: তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০% ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ সংশ্লিষ্ট অফিসার ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুরস্কার: যেসব পুলিশ অফিসার এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করেন, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপিএম, পিপিএম পদক প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।
গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীক গ্রুপিং: তিনি জানান, পুলিশে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় এবং গোপালগঞ্জ কেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে গ্রুপিং ঠেকাতে তাকে আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন দেওয়া হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গোপন বৈঠক ও চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন
আল-মামুন অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালের পর থেকে পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ভয়াবহভাবে বাড়ে।
গোপন বৈঠক: তিনি জানান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রায়ই রাতের বেলায় বৈঠক চলতো, যা গভীর রাত পর্যন্ত গড়াতো।
চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন: ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির এডিশনাল কমিশনার হারুনুর রশিদ, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম সহ বহু প্রভাবশালী কর্মকর্তা এসব বৈঠকে অংশ নিতেন। তাদের কারো কারো সাথে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ থাকায় তাঁরা চেইন অব কমান্ড মানতেন না।
র্যাবের ‘আয়নাঘর’ ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে গুমের নির্দেশ
২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত র্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও তিনি ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন।
গোপন বন্দিশালা: তিনি নিশ্চিত করেন, র্যাবের হেডকোয়ার্টার কর্তৃক পরিচালিত উত্তরাস্থ র্যাব-১ কমপাউন্ডের ভেতরে ‘টিএফআই সেল’ (টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত ছিল। র্যাবের অন্যান্য ইউনিটের অধীনেও এমন বন্দিশালা ছিল।
নির্যাতন ও ক্রসফায়ার: এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী ও সরকারের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের আটক রাখা, নির্যাতন করা এবং পরবর্তীতে ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো হতো।
গুমের নির্দেশনা: তিনি শোনেন যে, র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, আটক রাখা বা হত্যার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত।
























